আমি হলুদ সাংবাদিক বলছি ॥ পর্ব- ১

0 2

syedmhasan-1456325170-893893a_xlargeডেস্ক ২৪::কয়েকদিন পূর্বে স্থানীয় দৈনিক পূর্বে বাংলাদেশ বাণী পত্রিকায় “শর্ষিনা পীরের স্বাধীনতা পদক প্রত্যাহার করা হোক” শিরোনামে একটি বিশেষ প্রতিবেদন প্রকাশ করি। প্রতিবেদন দেখে আমার বন্ধু দৈনিক কালের কন্ঠের বরিশালের সাংবাদিক এম. সুহাদ ফোনে জানালো, আমি যে বিশেষ প্রতিবেদন লিখছি তা পড়ে সাংবাদিক জগতের অনেকেই হাসাহাসি করছে।

কেন হাসাহাসি করছে ? জানতে চাইলে বললো বিশেষ প্রতিবেদন লিখতে নির্দিষ্ট একটা বয়স অতিক্রম করতে হয়। যেহেতু সাংবাদিকতায় আমার তেমন বয়স হয়নি, ফলে লোকে টিপ্পনী কাটছে। আমি আবারও প্রশ্ন করেছিলাম, আচ্ছা কত বয়স হলে বিশেষ প্রতিবেদন লেখা যায় ? তথ্য-উপাত্ত সঠিক হলেইতো হলো।

প্রতিবেদনের সাথে প্রতিবেদকের বয়সের সম্পর্ক থাকাটা কতটা যৌক্তিক ? যদিও এই প্রশ্নের উত্তর দেননি আমার অত্যন্ত আপন সুহৃদ এম. সুহাদ। তবে ওর কথাই সত্য; নতুনরা সাহস দেখালে পুরাতন ও বুড়ো সাংবাদিকদের গাত্রদাহ শুরু হয়। তিরস্কার করেন। এ অভিজ্ঞতা আমার আগেও হয়েছে। তখন স্থানীয় অপর একটি দৈনিক বাজারে এসেছে মাত্র। সমসাময়িক ঘটনা নিয়ে “তিতা কথা” নামে একটা কলাম লিখছিলাম কিছুদিন। সাংবাদিকতায় কার হাত ধরে হামাগুড়ি দিতে শিখেছি, প্রাচুর্য রানা তখন তিনি কলমের কন্ঠের বার্তা সম্পাদক।

তিনি প্রায়ই আমাকে ডেকে নিয়ে বলতেন, তিতা কথা কলামের জন্য তার অনেক কথা শুনতে হচ্ছে। কি কথা ? জানতে চাইলে অগ্রজ এই সাংবাদিক বলেন, সিনিয়ররা তিরস্কার করে বলে, ওর যে কলাম ছাপছো আসলে কি কলাম লেখার বয়স হয়েছে ওর ? শেষে এক পর্যায়ে তিতা কথা বন্ধ করে দেই।

আজও যখন একই ধরণের কথা শুনি তখন খারাপ লাগে। আক্ষেপ জাগে বুড়ো সাংবাদিকদের হীনমন্যতা দেখে। যেহেতু মফস্বল এলাকায় যেসব সাংবাদিকরা সাংবাদিকতা করছেন এবং নিজেদের শরীরের দিকে তাকিয়ে বাকীদের চুনোপুটি বলে ছুড়ে ফেলছেন তাদের কারোরইতো সাংবাদিকতার স্বীকৃত কোন ডিগ্রী নেই। যা করছেন সবটুকু অভিজ্ঞতালব্ধ। তাহলে ছোটদের দেখে এত গা জ্বলছে কেন জানিনা।

এদিকে মফস্বল শহর বরিশাল। প্রায় প্রত্যেক মাসেই দেখা যাচ্ছে নতুন কোন পত্রিকার ডিক্লারেশন নিয়ে আক্কেলগুড়–ম। কেউ মিডিয়াপারসন বনে গেছেন। পাশাপাশি হু-হু করে বাড়ছে সাংবাদিকের সংখ্যা। টিভি মেকার, দেহ ব্যবসার হোটেল বয়, স্টুডিওর ক্যামেরাম্যান, বরিশাল সিটি কর্পোরেশনের সুইপার, পান দোকানী, বড় ধরণের ক্রিমিনাল থেকে শুরু করে গ্যারেজের ওয়াশম্যান পর্যন্ত দলে-দলে, পালে-পালে সাংবাদিকতার খাতায় নাম লেখাচ্ছে। আর ফটো সাংবাদিকদের প্রশ্নে আসলেতো কথাই নেই। ক্যামেরায় টিপ দিতে পারলেই হলো; তিনি বিরাট ফটো সাংবাদিক।

এই সাংবাদিক এবং ফটো সাংবাদিক তারা নিজেরা নিজেদের যেমন আঙ্গিকেই দেখুক আমজনতা কিন্তু তাদের চাঁদাবাজ বলেই জানে। পুলিশ দেখে যতটা না ভয় পায় একজন মফস্বলের সাংবাদিক দেখলে ততটা আতঙ্কে থাকে। কারন কার কাছ থেকে টাকা নিয়ে সত্যকে পাংচার করে কার বিরুদ্ধে কিছু লিখে ছাপিয়ে দেয় সেটা ভেবেই আতঙ্কিত।

বরিশালে আজকে দিন পর্যন্ত ২৩টি পত্রিকা প্রকাশ পাচ্ছে। এত যে পত্রিকা; কই অপরাধতো কমছেনা। ওদিকে অনলাইন পত্রিকার সংখ্যাতো অগনিত। যার কুড়ি হাজার টাকা দেবার সামর্থ আছে তিনিই একটা পত্রিকার মালিক। যেহেতু পত্রিকায় সমাজচিত্রের বিশেষ কোন পরিবর্তন হচ্ছেনা তাহলে ঘরে ঘরে এত পত্রিকা বৃদ্ধি পেয়ে ফায়দাটা কোন খানে ?

সাংবাদিকদের চাঁদাবাজ বলে না চেনার অবশ্য অন্য কোন কারনও নেই। এছাড়া তাদের হাতে ভিন্ন কোন পথও নেই। একটি সহজ হিসাব করুন। নগরীথেকে প্রিন্ট ভার্সনে ২৩টি দৈনিক পত্রিকা বের হচ্ছে। প্রত্যেকটি পত্রিকায় কমপক্ষে ৫ জন সংবাদকর্মী রয়েছে। অর্থাৎ লোকাল পত্রিকায় নগরীতেই কাজ করছে প্রায় ১১৫ জন। সাংবাদিকতার মূল ধারার বাইরে ঢাকার কিছু আন্ডার গ্রাউন্ডের পত্রিকার ব্যুরো প্রধান, প্রতিনিধি রয়েছে অন্তত ৫০ জন। ওদিকে অনলাইন পত্রিকার কমপক্ষে ১০০ জন রয়েছে যারা কার্ড নিয়ে নগরী দাবড়ে বেড়ায়। ফলে ছোট্ট নগরীতে মূল ধারার বাইরে সাংবাদিক দাপট নিয়ে চলছে আড়াইশ মানুষ।

মজার কথা হল, এরা কিন্তু বেতন পান না। লোকাল পত্রিকায় যারা কাজ করেন সেখানের বার্তা সম্পাদক পর্যায়ে ৩-৫ হাজার টাকা একমাসের বেতন ছ’মাস ঘুরিয়ে পত্রিকা কর্তৃপক্ষ দিলেও বার্তা সম্পাদকের নিচে যেসব সংবাদকর্মী কাজ করে তারা কিন্তু কোন টাকা পায়না পত্রিকা হাউস থেকে। অথচ দেখা যায় লাখ টাকার মোটর সাইকেল হাকিয়ে ছুটছেন এই অবৈতনিক সাংবাদিক।

তাহলে এর টাকার উৎস কী ? এমন প্রশ্ন জাগলে একটি বাস্তব অভিজ্ঞতার কথা বলি। আমার সাংবাদিকতার শুরুর দিকের কথা। একটি লোকাল পত্রিকায় তখন স্টাফ রিপোর্টার। ছাত্রাবস্থায় প্রতিদিন কুড়ি টাকা খরচা করে অফিসে গিয়ে নিউজ দিয়ে আসি। এমনি করে মাস পার হলো। বার্তা সম্পাদককে ও কম্পিউটার অপারেটরকে ডেকে নিয়ে বেতন দিলেন প্রত্রিকার প্রকাশক। তাদের দেখা দেখি আমিও গিয়ে বেতন চাইলাম। ওই প্রকাশক ভদ্রলোক আমি বেতন চাওয়ায় অন্তত দু’মিনিট আমার মুখে তাকিয়ে থাকলেন।

আমি চুপচাপ। শেষে বললেন, তোমাকে পত্রিকার আইডি কার্ড দিয়েছিনা ! আমি বলি হ্যাঁ দিয়েছেন। প্রকাশক ভদ্রলোক যথারীতি হতবাক হয়ে বলেন, তাহলে বেতন কিসের ? কার্ড দেখিয়ে কামাই করো। কথা শুনে আমি হতভম্ব হয়ে পরেছিলাম এবং তার পরদিন থেকে ওই পত্রিকায় যাইনি।

তাহলে ভাবুন, এই যদি হয় পত্রিকার মালিকের উক্তি তাহলে নগরী দাবড়ে বেড়ানো দুই-আড়াইশো সাংবাদিক, ক্যামেরা আর কলম ধরে চাঁদাবাজী, নারী ব্যবসার হোটেলে মাসোহারা, থানায় তদ্বির আর দালালি করবে না কেন ? আর যা হোক হাতুড়ে সাংবাদিক বোঝাই বরিশাল নগরীতে না খেয়েতো থাকা অসম্ভব।

আপনার ইমেইল ঠিকানা প্রচার করা হবে না.

Shares